Corona Virus live Update

Nagari Lipi (নাগরী লিপি)

সিলেটি নাগরী

 নাগরী লিপি
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি লেখ্য লিপি, যা বর্তমানে ব্যবহৃত হয় না।নাগরী  বাংলা লিপির বিকল্প এক প্রকার লিপি। সিলেটের বাইরে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ভারতের আসামের  কাছাড় এবং করিমগঞ্জেও এই লিপির প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। লিপিটি মূলত বাংলা, কায়থী এবং দেবনাগরী থেকে উদ্ভূত। এই লিপি দিয়ে শুদ্ধ বাংলা, সংস্কৃত কিংবা প্রাকৃত নয়, বরং সিলেটি ভাষাই লেখা হতো।
ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বাস করা হয়, ব্রাহ্মী লিপি, হিন্দুধর্মমতে স্রষ্টা ব্রহ্মার পক্ষ থেকে দেওয়া একটি লিপি, তাই সিলেটের মুসলমানগণ এই লিপি ব্যবহার করে তাদের সাহিত্যরচনা কিংবা লেখালেখী করতে অস্বীকৃত হন। আর তাই ধর্মীয় অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁরা আরবি আর ফার্সি হরফকে নিজেদের হরফ বলে ধরে নিয়ে আলাদা একটি লিপি তৈরি করে নেওয়ার তাড়না অনুভব করেন। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম হয় নাগরী লিপির। যদিও জন্মগতভাবে সিলেটী নাগরী একটি ব্রাহ্মী লিপি এবং বিহারের কায়থী লিপির এবং বাংলা বর্ণমালার সাথে এ লিপির ব্যাপক মিল লক্ষণীয়।
উদ্ভব:
এই লিপির সৃষ্টি সম্পর্কে পরস্পর-বিরোধী বিভিন্ন ধারণামূলক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সাধারণ ধারণা হলো সিলেটের মুসলমানরাই এই লিপির উদ্ভাবক, তবে তুলনামূলক নিচু জাতের লোকেরা এই লিপির চর্চা করতেন। আবার ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের মতে, বিখ্যাত ধর্মীয়-পরিব্রাজক জনাব শাহ জালাল [রহ.] ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দিতে যখন সিলেট আগমন করেন, তিনিই এই লিপি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। নাগরী লিপিতে রচিত বিপুল সংখ্যক এবং সিংহভাগ সাহিত্যকর্মই সুফিবাদ অনুসরণ করে বলে এই ধারণা অমূলক মনে হয় না। অন্যদিকে ড. আহমদ হাসান দানীর মতে, আফগান শাসনের সময়, অর্থাৎ আফগানরা যখন সিলেটে অবস্থান করতেন, ঐ সময়ই তাঁদের দ্বারা এই লিপির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। এই মতকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় আফগান মুদ্রায় উল্লেখিত লিপি, যার সাথে সিলেটি নাগরীর কয়েকটি বর্ণের মিল রয়েছে। তাছাড়া সিলেটে আফগান অভিবাসীও সংখ্যায় অনেক ছিলেন। এই দুই ব্যাখ্যা সিলেটি নাগরীর উদ্ভবের ইতিহাস হিসেবে প্রাধান্য পেলেও আরো যেসব মতামত প্রচলিত আছে সেগুলো হলো:
      • দেবনাগরীর সঙ্গে যেহেতু সিলেটবাসী পরিচিত ছিলেন, তাই দেবনাগরীর আদলেই এই লিপি সিলেটিরা              তৈরি করে নিয়েছিলেন;
      • প্রতিবেশী নেপাল ইত্যাদি দেশ থেকে আগত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাধ্যমে এই লিপি সিলেটে উদ্ভাবিত হয়;
      • সম্ভবত সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দিতে বিহার যুক্তপ্রদেশ থেকে আগত মুসলমান সিপাহী ও বিদেশাগত          মুসলমানদের সুবিধার জন্য সিলেটি নাগরী লিপির সৃষ্টি হয়
      • যৌক্তিকতা কিংবা উৎস নির্দেশ না করেই বলা হয় কোনো এক সুচতুর মুসলমান মুসলিম জনগণের                মধ্যে সাধারণ লেখাপড়া চালু করার নিমিত্তে বাংলা লিপি থেকেই এই নাগরী লিপি তৈরি করে নেন। এটা            মূলত লৌকিক বিশ্বাস।
তবে সব মতামত যাচাই করে বিশেষজ্ঞগণ সাকুল্যে তিনটি মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন: শাহ জালালের [রহ.] সময়ে তাঁর অনুসারীদের দ্বারা, আফগান শাসনামলে আফগানদের দ্বারা কিংবা দোভাষী পুঁথির সমান্তরালে সিলেটেই এর সূত্রপাত।


সিলেটি নাগরী লিপির সহজবোধ্যতা আর সহজসাধ্যতা সাধারণ্যের সাহিত্য রচনার দুয়ার উন্মোচন করেছিল, আর তারই ফলশ্রুতিতে রচিত হয়েছে বিপুল সংখ্যক নাগরী সাহিত্য। তৎকালীন শ্রীহট্ট শহরের ইসলামীয়া প্রেস, সারদা প্রেস ও কলিকাতার জেনারেল প্রিন্টিং প্রেসে নাগরী লিপিতে লেখা ছাপা হতো। নাগরী লিপিতে রচিত পুঁথি কিছুটা গল্প ও উপন্যাস-শ্রেণীর।তবে কবিতাও কম রচনা হয়নি এই লিপিতে। এসকল কবিতা যথেষ্ট ভাবমন্ডিত। নাগরী লিপিতে পএআর ছন্দে লেখা সিলেটি ভাষার একটি কবিতার প্রথম ৮ চরণ এরকম:
                       ওহে মন বুইদধি জদি থাকে তর মাজে।
                       মিলিওনা তুমি কভু নাদান শমাজে।
                       নাদান জাহেল জারা মুরখ জগতের।
                       ভালো কাম নাহি ফলে ছহবতে তাদের।
                       জাহিল হইতে শদা তফাত রহিবে।
                       তার শাতে দুস্তি কইলে বিপদে ঠেকিবে।
                       দুস্ত নাদান থাকি দুশমন দানা।
                       শত গুনে ভালো হএ কি দিব তুলনা।




সিলেটি নাগরীতে লিখিত এযাবৎ প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ হচ্ছে--

সাধক কবি গোলাম হুছনের তালিব হুছন (১৫৪৯),  

ফাজিল নাসির মোহাম্মদ রাগনামা (১৭২৭), 
সৈয়দ শাহ নূর নূর নছিহত (১৮১৯), রাগনূর, সাতকন্যার বাখান
শাহ হুছন আলম  ভেদসার
শীতালাং শাহ  মুশকিল তরান, হাসর তরান, রাগবাউল, কেয়ামতনামা, শীতালাঙ্গী রাগ
নছিম আলী হরুফুল খাছলাত (১৮৭৫), 
মুন্সী মোহাম্মদ সাদেক আলী হালতুন্নবী (১৮৫৫), মহববতনামা, হাসর মিছিল, রদ্দেকুফুর ইত্যাতি গ্রন্থ রচনা করেন। 
আবদুল করিম রচিত কড়িনামা, ছদছী মছলা, সোনাভানের পুঁথি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্যে ষাটজন লেখকের মুদ্রিত ও পান্ডুলিপি মিলিয়ে 
লেখকের নামবিহীন জনপ্রিয় পুথিগুলির মধ্যে হরিণনামা, হুশিয়ারনামা, সফাতুন্নবী, আবু সামা, নূর নাজাত, পেঁচার গল্প  ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

Posted by: Sourav Dash

No comments

Theme images by konradlew. Powered by Blogger.